আলী আহসান রবি :-
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়-এর স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) ১৯৭৯ সাল থেকে অর্থাৎ প্রায় ৪৬ বছর ধরে দেশব্যাপী শিশু, কিশোরী এবং সন্তান ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন নারীদের টিকা দিয়ে প্রতিরোধযোগ্য বিভিন্ন সংক্রামক রোগজনিত মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সারা দেশে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে।
বাংলাদেশে টিকা দিয়ে প্রতিরোধযোগ্য মারাত্মক সংক্রামক রোগগুলোর মাঝে টাইফয়েড জ্বর অন্যতম। Salmonella Typhi নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এই রোগ হয়ে থাক। বিশ্বে টাইফয়েড প্রাদুর্ভাব অঞ্চল সমুহের মাঝে বাংলাদেশ অবস্থান করছে। মূলত দূষিত পানি, খাবারের মাধ্যমে এবং পরিষ্কার পরিচ্ছনতার অভাবে টাইফয়েড ছড়িয়ে থাকে। Global Burden of Disease Study এর তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে বিশ্বে ৭০ লক্ষের বেশি মানুষ টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয় এবং তার মাঝে প্রায় ৯৩০০০ জন মৃত্যুবরণ করে যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দক্ষিণ এশিয়ায়। বাংলাদেশে ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সি শিশুরাই টাইফয়েড জ্বরে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৮০০০ মানুষ টাইফয়েড জ্বরে মৃত্যুবরণ করে যার মধ্যে ৬৮ % অর্থাৎ প্রায় ৬০০০ জন ১৫ বছরের কম বয়সি শিশু। উপরন্তু বর্তমানে বৈশ্বিক এক স্বাস্থ্যঝুঁকি আর উদ্বেগের নাম ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েড (Multi Drug Reistance- Typhoid)। টাইফয়েড জ্বরের চিকিৎসায় প্রচলিত যেসব এন্টিবায়োটিক ব্যবহার হয় তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বর্তমান টাইফয়েড নিরাময়ে কাজ করছে না। ফলে ভয়াবহ ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েড জ্বরের প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। টাইফয়েড টিকা গ্রহণ করলে এই জ্বরে আক্রান্ত হবার হার বহুলাংশে হ্রাস পাবে ফলে এন্টিবায়োটিক এর অপপ্রয়োগ কমে আসবে।
এই ধারাবাহিকতায় আগামী ১২ অক্টোবর ২০২৫ হতে মাসব্যাপী সারাদেশে টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন-২০২৫ শুরু হতে যাচ্ছে যা শিশুদের টাইফয়েড সংক্রমণজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যুহার বহুলাংশে হ্রাস করবে। ক্যাম্পেইনের আওতায় প্রায় ৫ কোটি শিশুর প্রতিজনকে অত্যন্ত কার্যকর ১ ডোজ টাইফয়েড টিকা বিনামূল্যে প্রদান করা হবে। উল্লেখ্য যে, উক্ত টিকাদান কার্যক্রম চলাকালে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত প্রাক-প্রাথমিক ( প্লে, নার্সারি, কিন্ডারগারটেন) থেকে ৯ম শ্রেণি/ সমমান ( মাদ্রাসা, ইংরেজি মিডিয়াম )পর্যন্ত সকল ছাত্র ছাত্রীকে নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহির্ভুত ০৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী সকল শিশুদের কমিউনিটি পর্যায়ে ইপিআই টিকাদান কেন্দ্রে বিনামূল্যে ১ ডোজ টাইফয়েড টিকা প্রদান করা হবে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় , শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় সহ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, কওমি মাদ্রাসা, স্কাউট ও গার্লস গাইড এর সাথে সমন্বয়পূর্বক টিকা কার্যক্রমকে সফলভাবে বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তর , এনজিও বিষয়ক ব্যুরো, এবং বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও এর সহযোগিতায় সুবিধাবঞ্চিত শিশু, বেদে পল্লী, চা বাগান, এতিমখানা, শিশু/ কিশোর/কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র, পথশিশু, যৌনপল্লীতে থাকা শিশুদের তালিকা করে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় টাইফয়েড টিকা প্রদানের ব্যবস্তা করা হচ্ছে।
ইপিআই বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবায় একটি অন্যতম সফল কার্যক্রম হিসেবে দেশ ও বিদেশে বহুল প্রশংসিত। ইপিআই টিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ৪২ লক্ষ শিশুকে বিভিন্ন প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে টিকা দেওয়া হয় এবং এর মাধ্যমে প্রায় ১ লক্ষ শিশু মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হচ্ছে। আসন্ন ক্যাম্পেইনে ইপিআই এর ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে যে টাইফয়েড টিকা দেওয়া হবে সেটি বিশ্ব (Prequalified) ও নিরাপদ । এটি Conjugate Vaccine বিধায় অর্থাৎ একই সাথে প্রোটিন ও শর্করা থাকায় দুটি উপাদানই শরীরে টাইফয়েড রোগ প্রতিরোধী এন্টিবডি তৈরি করে। তাই অন্যান্য টাইফয়েড টিকার তুলনায় এটি উন্নততর এবং অধিক কার্যকর। বাংলাদেশে এই টিকা কোন প্রকার ট্রায়াল বা পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার দেশের শিশুদের নিরাপদ ও কার্যকর টিকা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ। সামান্যতম সন্দেহ বা ঝুঁকি থাকলে সেই টিকা প্রয়োগের সিদ্ধান্ত সরকার কখনই নেয় না। টাইফয়েড টিকাসহ ইপিআই প্রদত্ত সকল টিকা সঠিক তাপমাত্রায় পরিবহন এবং সংরক্ষণ করা হয়। তাই সরকার প্রদত্ত এই টিকা নিয়ে কোন প্রকার সংশয় বা বিভ্রান্ত হবার কোন অবকাশ নেই।
পাকিস্তান ২০১৯ এবং নেপাল ২০২২ সাল থেকে শিশুদের এই Typhoid Conjugate Vaccine প্রদান করছে এবং তাদের দেশে শিশুদের মাঝে কোন বিশেষ বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। ভারতের মুম্বাই সিটি কর্পোরেশনেও এই টিকার ক্যাম্পেইন হয়েছে। টাইফয়েড টিকা গ্রহণের পর অন্যান্য টিকার মতই সামান্য প্রতিক্রিয়া যেমন টিকাদানের স্থান লালচে হওয়া, সামান্য ব্যথা, মৃদু জ্বর, ক্লান্তি ভাব হতে পারে যা এমনিতেই ভাল হয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে টিকা গ্রহণের সময় দেখা যায় একই সাথে অনেক কিশোর কিশোরী অসুস্থতা বোধ করছে বা অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। এতে আতংকিত হবার কিছু নেই, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে Mass Psychogenic Illness বলে যা টিকা গ্রহণের পূর্বে বা পরে মানসিক ভীতি জনিত কারনে হয়ে থাকে, এটি একটি ভীতি জনিত প্রতিক্রিয়া যার সাথে টিকা জনিত অসুস্থতার কোন সম্পর্ক নেই। আরেকটি তথ্য প্রদান করা প্রয়োজন মনে করছি , এই টিকায় শরীয়ত নিষিদ্ধ কোন উপকরণ নেই, টাইফয়েড টিকা সৌদি হালাল সেন্টার কর্তৃক হালাল সনদপ্রাপ্ত।
কিভাবে রেজিস্ট্রেশন করতে হবেঃ
Vaxepi.gov.bd ওয়েবসাইটে ১৭ সংখ্যার জন্মনিবন্ধন তথ্য দিয়ে খুব সহজেই টাইফয়েড টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশন করা যাবে। এই ক্যাম্পেইন সফলভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য VaxEPI প্লাটফর্মের মাধ্যমে শিশুদের নিবন্ধন চলমান আছে। গতকাল পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ৬৮ লক্ষ শিশু টাইফয়েড টিকার জন্য নিবন্ধিত হয়েছে।
যাদের জন্ম নিবন্ধন সনদ নেই তাদের তালিকা প্রস্তুত করে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে।
এছাড়াও এই ক্যাম্পেইনে ডিজিটাল অনলাইন প্লাটফর্ম এর মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের মাইক্রোপ্লান এবং রিপোরটিং সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এই ক্যাম্পেইনে সর্বোচ্চ কাভারেজ নিশ্চিত করার জন্য মাল্টিমিডিয়া কমিউনিকেশান এপ্রোচ অনুসরন করা হয়েছে, যাতে সকল শ্রেনীপেশার মানুষ, শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের এই টিকা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারে। সে লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ উপকরণ যেমন পোস্টার, লিফলেট, ফ্যাক্টশিট, FAQs, ইনফোগ্রাফ, ব্যানার, জিংগেল, টেলিভিশন ও রেডিওতে প্রচারের জন্য অডিওভিজ্যুল উপকরণ। এছাড়াও জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততাকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে এডভোকেসি কর্মশালার আয়োজন চলমান রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিক্ষক, ইয়ুথ ভলান্টিয়ার, ধর্মীয়নেতৃবৃন্দ, সংবাদকর্মী এবং স্বাউট ও গার্লস গাইড এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় কর্মরত বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার মাঠপর্যায়ের কর্মীগণ।
টাইফয়েড টিকা খুবই নিরাপদ। এরপরেও টিকাদান পরবর্তী বিরুপ ঘটনা (AEFI) মোকাবেলার জন্য জেলা/উপজেলা এবং সিটি কর্পোরেশান পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সকল কমিটির প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে এবং সকল পর্যায়ে AEFI কিট box ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে।
কিছু কিছু মানুষের মধ্যে এই টিকা নিয়ে আস্থাহীনতা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল তথ্য প্রচারের প্রবনতা লক্ষ করা গেছে।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় যেকোনো নতুন টিকা প্রদানকালে ওই টিকা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে পর্যাপ্ত ধারনা থাকে না বিধায় টিকা সম্পর্কে নানা ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করে থাকে যা টিকা প্রদান কার্যক্রমকে ব্যাহত করতে পারে। তাই টাইফয়েড টিকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য ক্যাম্পেইন সংগঠন সহায়িকা, সচরাচর জিজ্ঞাসা লিফলেটে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিবাচক ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। । টিকা সম্পর্কে মনগড়া কোন মন্তব্য বা মতামত না দিয়ে বিস্তারিত জানার জন্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা/সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জনের অথবা কোন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের সহায়তা নিতে হবে।
যদি কোন অপপ্রচার হয়ে থাকে, তাহলে তা সমাধানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ কিম্বা ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সহায়তা নিতে পারেন। প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে আমাদের মনে রাখতে হবে টিকার কারনেই বাংলাদেশ পোলিও মুক্ত হয়েছে, হেপাটাইটিস -বি, হাম রুবেলা নিয়ন্ত্রনে এসেছে, মা ও শিশুর ধনুষ্টংকার দূরীকরণ হয়েছে, ভবিষ্যতে টিকা দিয়েই টাইফয়েড রোগ নিয়ন্ত্রন এমনকি নির্মূল করা সম্ভব হবে।
সাংবাদিকরা জাতির কণ্ঠ, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে আপনারা জনগণকে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখেন। তাই আসুন আপনাদের লেখনী ও বস্তুনিষ্ট তথ্য প্রচারের মাধ্যমে দেশের শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ১ ডোজ টাইফয়েড টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করি। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুরক্ষিত হোক আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ, গড়ে উঠুক একটি সুস্থ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।