আব্দুল হামিদ:
রোজকার মতো রোববারও রাতের খাবার খেয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে ঘুমাতে যান ইসরাত জাহান। তখনও তিনি জানতেন না, ভোরটা এমন আগ্রাসী হয়ে আসবে! ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে কাতরাতে থাকা ইসরাত গতকাল সোমবার সমকালকে বলেন, ‘‘আগুন লাগার পর পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে যখন বাসায় আটকা পড়ি, তখন ছোট মেয়ে ইশায়েত আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে– ‘আম্মু, আমরা কি এখন মরে যাব?’ ওর কথা শুনে আমি রীতিমতো স্তব্ধ।
ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখে দুই মেয়েকে নিয়ে ভয়ে বাথরুমে চলে যাই। সেখানে তাদের শরীরে পানি ঢালতে থাকি। আধাঘণ্টা বাথরুমে থাকার পর আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে। শুধু মেয়ে দুটির মুখের দিকে তাকিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করেছি। ওপরওয়ালার ইচ্ছায় আমরা এখনও বেঁচে আছি।”
গতকাল ভোর ৪টার দিকে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের মাক্কুশা মাজারের পাশের পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ওই ভবনের নিচে ‘রিয়াদুল উড ফার্নিচার’ দোকানের ব্যবস্থাপক আমিন উদ্দিনের (৭৪) মৃত্যু হয়েছে। তাঁর গ্রামের বাড়ি যশোরের শার্শার উলশীতে। এ ঘটনায় দগ্ধ ও গুরুতর অসুস্থ হয়েছেন দুই পরিবারের ১২ সদস্যসহ ১৩ জন।
আহতরা হলেন চারতলার ফ্ল্যাটের মালিক ব্যবসায়ী ইকবাল হোসেন (৪৭), তাঁর স্ত্রী ইসরাত জাহান (৩৬), তাদের দুই মেয়ে ইশতিমাম (১২) ও ইশায়েত (১০), ইকবালের মা মমতাজ বেগম (৬৫) ও ইসরাতের বোনের মেয়ে মুশফিকা আক্তার (২৫)। এ ছাড়া পাঁচতলার ভাড়াটিয়া ইউনুস মিয়া (৭৪), তাঁর স্ত্রী রাহেলা বেগম (৬০), তাদের ছেলে মো. আমিন (২৭) ও মো. বুলবুল (৩৭), মেয়ে শিল্পী আক্তার (৪০) ও শিল্পীর মেয়ে তালহা (৩) এবং দোকান কর্মচারী সাকিব হোসেন (২২)।
ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. হারুনুর রশীদ বলেন, ভোরে ১৩ জনকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এর মধ্যে ইকবাল হোসেনের শরীর ২ শতাংশ পুড়েছে। বাকিদের বাহ্যিক কোনো দগ্ধ নেই। তবে সবারই শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত। মুশফিকা ও রাহেলা আইসিইউতে। ২৪ ঘণ্টা পার না হলে অন্যদের ব্যাপারে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
গতকাল দুপুরে বার্ন ইউনিটের ৫০১ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, ইকবাল-ইসরাত দম্পতি ও তাদের দুই মেয়ের চিকিৎসা চলছে। ইকবালের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে শ্বাসকষ্টের কারণে কিছুই বলতে পারেননি। পরে তাঁর স্ত্রী ইসরাত জাহান বলেন, ‘ভোর ৪টার দিকে চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে যায়। এরপর আগুন লেগেছে শুনে স্বামী, দুই মেয়ে, শাশুড়ি ও বোনের মেয়েকে ডেকে তুলি। পরে সবাই বাসা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করি। তখন পুরো বাসা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। এ পরিস্থিতিতে ইকবালকে তৎক্ষণাৎ খুঁজে না পেয়ে আমি মেয়েদের নিয়ে বাথরুমে ঢুকি। শাশুড়ি ও বোনের মেয়েকে তাদের কক্ষের বাথরুমে অবস্থান নিতে বলি। তারা বাসার ভেতরেই মেঝেতে পড়ে যায়। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা দু’জনকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করেন। এখন দু’জনই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি।’
তিনি বলেন, ‘আগুন লাগার এক ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ডাকাডাকি করলে বাথরুমের দরজা খুলে দিই। সেখান থেকে আমাদের উদ্ধার করা হয়। হাসপাতালে এসে দেখি, ইকবালের দুই হাত ও পা পুড়ে গেছে।’
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম রনি বলেন, ‘ভবনের নিচতলার একটি তোশকের দোকানের বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুনের সূত্রপাত। এতে দুই লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ভবনের অন্য তলায় আগুন পৌঁছায়নি। তবে ধোঁয়ার ব্যাপকতায় ভবনের বাসিন্দারা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমরা ১৩ জনকে ঢামেক বার্ন ইউনিটে পাঠিয়েছি।’
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাকিব হোসেন বলেন, ‘অভাব-অনটনের সংসারে বাড়তি রোজগারের আশায় ঈদের পর প্রতিবেশী দাদা আমিন উদ্দিন আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এর মধ্যেই দাদাকে হারালাম। নিজের জীবনও সংকটাপন্ন।’ সাকিব বলেন, ‘ভবনের নিচতলায় ফার্নিচারের দোকানে ঘুমিয়ে ছিলাম। আগুন
লাগলে চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। এরপর দৌড়ে দোতলায় গিয়ে দাদা আমিনকে ডাকি। দরজার সামনে আগুন জ্বলছে দেখে আমরা বের হতে পারিনি। পরে আমি বাথরুমে অবস্থান নিই। দাদা দোতলার বাথরুমে যাওয়ার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।’
এদিকে চিকিৎসাধীন ইউনুস মিয়ার জামাই শফিকুল ইসলাম জানান, তাঁর শ্বশুর পরিবার নিয়ে ওই ভবনের পাঁচতলায় থাকেন। ভোরে নিচতলায় আগুন লাগলে পুরো ভবনে ধোঁয়ার ছেয়ে যায়। এ কারণে কেউ বাইরে বের হতে পারেননি। পরে ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।